Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

March 14, 2024

বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র মিত্র স্মৃতি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা

 


অভিজিৎ হাজরা, আমতা, হাওড়াঃ গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের আমতা ১ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত রসপুর হাই স্কুল ফুটবল মাঠে অনুষ্ঠিত হল ৪র্থ বর্ষ বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র মিত্র স্মৃতি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ২০২৪। প্রশাসনিক স্তরে উপেক্ষিত বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র মিত্র প্রসঙ্গে জানা যায়, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্ৰামের ইতিহাসে উল্লেখিত ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রথম অস্ত্র লুন্ঠন হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৬ আগষ্ট। যা রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠন হিসাবে পরিচিত। এই অস্ত্র লুন্ঠনের মূল কান্ডারী ছিলেন হাওড়া জেলার আমতা থানার রসপুর গ্ৰাম নিবাসী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র।

বিপ্লবী মহানায়ক বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এক অভিন্ন বন্ধুর সহযোগিতায় ১৯১৩ সালের আগস্ট মাসে শ্রীশচন্দ্র মিত্র কে আর.বি.রডা কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ করে দেন। কর্মদক্ষতার পরিচয় দেওয়ায় দু'মাসের মধ্যে শ্রীশচন্দ্র 'জেটি ক্লিয়ারিং ক্লার্কের' পদে উন্নীত হন। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কর্মপটুতার জন্য তাঁর সাহেবদের নজরে পড়তে অসুবিধা হয় নি।১৯১৩ সালের আগস্ট মাসে থেকে ১৯১৪ সালের ২৬ আগষ্ট পর্যন্ত কমপক্ষে তিনি চল্লিশবার কোম্পানির মাল খালাস করেছিল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।

ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের হাত থেকে শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য বিপ্লবীদের অস্ত্রের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।১৯১৪ সালের ২৬ আগষ্ট বাংলা তথা ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি স্মরণীয় দিন। ঘটনার দিন ১৯১৪ সালের ২৬ আগষ্ট বেলা আড়াইটে কি তিনটা ব্রিটিশ সরকারের অস্ত্র আইন ইন্সপেক্টর পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী তখন লালদীঘির ভিতর তাঁর অনুচরদের নিয়ে গল্পে ব্যস্ত। এদিকে কাস্টমস্ হাউস থেকে পূর্ব পরিকল্পনা মতো এক এক করে ছয় টি গরুর গাড়ি বোঝাই হল ।সপ্তম গাড়ি যার চালক ছদ্মবেশী হিন্দুস্তানী গাড়োয়ান " কুঞ্জ " ( হরিদাস দত্ত) ।শ্রীশচন্দ্র মিত্র "কুঞ্জ" - গাড়িতে তুলে দিলেন বাক্স ভর্তি ৫০ টি মাউজার পিস্তল,৫০ টি অতিরিক্ত স্পিং এবং ৫০ টি পিস্তলের খাপ।যার সাহায্যে পিস্তলগুলিকে রাইফেলের মতো বড় করে ব্যবহার করা যায়।আর সেই সঙ্গে তুলে দেন ৫০ রাউন্ড কার্তুজ।রডা কোম্পানির অস্ত্র লুঠ হয়ে গেল। এরপর শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র নিরুদ্দেশ হন।

অস্ত্র লুঠ হয়ে যাওয়ার পর ঐ অস্ত্র গুলি বিভিন্ন বিপ্লবী দলের মধ্যে বন্টন হয়ে যায়।ঐ অস্ত্রের সাহায্যে কলকাতার গার্ডেনরিচে বার্ণ কোম্পানির মিল এ ১৮ হাজার টাকা লুঠ হয়।বেলেঘাটায় চালের গুদামে ২০ হাজার টাকা লুঠ হয়। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার মোড়ে সরকারি গুপ্ত বিভাগের পুলিশ কর্মচারী সুরেন বন্দোপাধ্যায়কে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশ ইন্সপেক্টর মধূসুদন ভট্টাচার্যকে মেডিক্যাল কলেজের সামনে পুলি লেনের কাছে গুলি করে মারে।যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন) বালেশ্বরে গেলেন রডা কোম্পানির লুঠের অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে জার্মানি থেকে প্রেরিত জাহাজের অস্ত্র নামাতে।১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বালেশ্বরে বুড়ি বালামের তীরে বাঘা যতীন ও তাঁর দুধর্ষ সতীর্থবৃন্দ মাউজার পিস্তল নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।১৯৩০ সালে ৮ ডিসেম্বর রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করলেন বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত,বাদল গুপ্ত।ওই অলিন্দ যুদ্ধে যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা ও আগের লুঠ হওয়া মাউজার পিস্তল।১৯৩২ সালে ২৯ অক্টোবর বিম দাসগুপ্ত ক্লাইভ স্টিটের গিলওর্স হাউসে ঢুকে ইউরোপীয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ভিলিয়ার্সকে মাউজার পিস্তলের গুলি করেন।রডা অস্ত্র লুঠের পর একটি মাউজার পিস্তল ব্যবহার করতেন রাসবিহারী বসু।রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠনের পর অনুষ্ঠিত ৫৪ টি ডাকাতি, নরহত্যার ঘটনায় মাউজার পিস্তল ব্যবহার হয়েছিল।

অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় রডা অস্ত্র লুন্ঠনের অন্যতম নায়ক শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র এর জন্য বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব পান নি। অধিকাংশ মানুষই জানেই না এত বড় একটি ঘটনার কৃতিত্ব আসলে কার। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত রাজ্য প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন এ হেন বিপ্লবীর স্মৃতি রক্ষার জন্য কিছুই করেন নি। স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীশচন্দ্র (হাবু ) মিত্রের পৈতৃক ভূমির উপর তাঁর স্মৃতিতে তদানীন্তন ইউনিয়ন বোর্ডের সহায়তায় গ্ৰামবাসীবৃন্দ একটি বেদী নির্মাণ করেছিলেন। বতর্মানে সেই বেদীর কোন অস্তিত্বই নেই।বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ বাস্তুভিটা ও দখল হয়ে গেছে।


অনেক পরে ১৯৮৩ সালে শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি রক্ষা সমিতি গঠিত হয় রসপুর পিপলস লাইব্রেরীর উদ্যোগে।ঐ বছর ২৬ আগষ্ট রডা অস্ত্র লুন্ঠনের ৭০ তম বর্ষে রসপুর পিপলস লাইব্রেরীর পাশে শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়।পি ডব্লু ডি রাস্তা থেকে শ্রীশচন্দ্র মিত্রর বসত বাড়ি যাওয়ার রাস্তা নামকরণ করা হয় " শ্রীশচন্দ্র সরণী "। ঐ নামকরণ ফলকে তাঁর জম্ম ও মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করা হয় নি। কলকাতা মলঙ্গা লেনে তিনজন স্বাধীনতা সংগ্ৰামীর স্মৃতি মঞ্চ আছে। সেখানে অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিদাস দত্ত - র মূর্তির সঙ্গে তাঁদের জম্ম ও মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ আছে।শ্রীশচন্দ্র -র স্মৃতি ফলক থাকলেও তাঁর কোন মূর্তি নেই, নেই জম্ম ও মৃত্যুর তারিখ।কারণ তাঁর জম্ম ও মৃত্যুর তারিখ যেমন পাওয়া যায় নি, তেমনি তাঁর কোন ছবি পাওয়া যায় নি।

পিডব্লুডি রাস্তা থেকে শ্রীশচন্দ্র মিত্রর বসত বাড়ি যাওয়ার রাস্তা নামকরণ যখন করা হয় তখন রাস্তা টি ছিল মাটির। তারপর রাস্তাটি মোরাম রাস্তা হয়।তারপর রাস্তাটি পিচ রাস্তা হয় ।পিচ রাস্তা হওয়ার সময় বাঁধ সংলগ্ন স্থানের নামকরণ স্মৃতি ফলক টি তুলে ফেলা হয়।আজ পর্যন্ত সেই স্মৃতি ফলক আর লাগানো হয় নি।
আগষ্ট মাস এলেই রসপুর গ্ৰামের মানুষ, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়,বি এড কলেজ, প্রাইমারি টিচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এর ছাত্র -ছাত্রী, শিক্ষক - শিক্ষিকা,অশিক্ষক কর্মচারীদের মনে পড়ে যায় শ্রীশচন্দ্র মিত্র র দেশের জন্য আত্মত্যাগের কথা। তাঁকে একমাত্র স্মরণ করা হয় ২৩ জানুয়ারি,২৬ জানুয়ারি,১৫ আগষ্ট, শুধুমাত্র তাঁর স্মৃতি স্তম্ভে মাল্যদান করে। কয়েক বছর হল রসপুর পিপলস লাইব্রেরী ও শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি রক্ষা সমিতি ও রসপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির যৌথ উদ্যোগে ২৬ আগষ্ট দিনটি মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়।২০১৪ সালে ২৬ আগষ্ট রডা অস্ত্র লুন্ঠনের শতবর্ষ মর্যাদার তাঁরা পালন করেছে।
রসপুরের পার্শ্ববর্তী কলিকাতা গ্ৰামের " অগ্ৰগতি" গণ সংগঠন তাদের বাৎসরিক "দামোদর মেলা" -র তৃতীয় বর্ষে ১৯৯৪ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর মূল মঞ্চকে ঘিরে ৩৫ টি মন্ডপের মধ্যে একটি মন্ডপের নামকরণ করে শ্রীশচন্দ্র মিত্র। দামোদর মেলার ৫ম বর্ষে ১৯৯৬ সালে দামোদর মেলার মূল সাংস্কৃতিক মঞ্চের নামকরণ করেছিল ' শ্রীশচন্দ্র মিত্র স্মৃতি মঞ্চ'।
এই দেশপ্রেমিকের স্মৃতি রক্ষায় কেউ আন্তরিকতার সহিত এগিয়ে আসেনি।

পরিতাপের বিষয়, স্থানীয় গ্ৰাম পঞ্চায়েত, আমতা১ নং পঞ্চায়েত সমিতি,হাওড়া জেলা পরিষদ, বিধায়ক, সাংসদ কেউ কোনো উদ্যোগ নেয় নি। শ্রীশচন্দ্র মিত্র স্মৃতি রক্ষা সমিতি বিপ্লবীর বাস্তুভিটা সংস্কার ও বাস্তুভিটায় স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ এর জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন ওই বাড়িতে দখলদার মানুষদের প্রবল বাধায় তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয় নি। বিষয় টি স্থানিয় প্রশাসন, বিধায়ক, সাংসদ কে জানানো সত্ত্বেও কেহই কোন উদ্যোগ নেয় নি।

আমতা-১ ব্লকের দামোদর নদের তীরে বসবাসকারী বেশ কয়েকটি পরিবার প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়ে।তারা তখন আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে রসপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বেশ কয়েক বছর আগে আমতা ১ নং পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে রসপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে ফ্লাড রেসকিউ সেন্টার এর গৃহ নির্মাণ করে। সরকারি ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ওই ফ্লাড রেসকিউ সেন্টারের নামকরণ করা হবে " শ্রীশচন্দ্র মিত্র ফ্লাড রেসকিউ সেন্টার। রেসকিউ সেন্টারটি হলেও নামকরণ আর করা হল না।
এহেন বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র মিত্র-কে সম্মান জানিয়ে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শতাব্দী প্রাচীন রসপুর বীণাপাণি ক্লাবের পরিচালনায় এক সীমিত ওভারের আট দলীয় ক্রীকেট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হল রসপুর হাই স্কুল ফুটবল মাঠে। এবারের এই ক্রিকেট প্রতিযোগিতাটি ছিল চতুর্থ বর্ষের ৭ দিন ব্যাপী ক্রমপর্যায়ে আট দলীয় এই ক্রিকেট প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হল।

চূড়ান্ত পর্বের খেলাটি অনুষ্ঠিত হল নির্ধারিত ১৫ ওভারে রসপুর বীণাপাণি ক্লাব ও ভবানীপুর (উদয়নারায়ণপুর) রায়বাঘিনী রয়াল স্টাইকার্স এর মধ্যে।বিজয়ী হয় রসপুর বীণাপাণি ক্লাব। চূড়ান্ত পর্বের এই খেলায় উপস্থিত ছিলেন আমতা থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ অজয় সিং, রসপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রেমচাঁদ রায়, রসপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েত প্রধান অর্জুন দলুই, আমতা-১ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সুমিত মন্ডল,প্রাক্তন ক্রীড়াবিদ ও সমাজসেবী বনমালী পাত্র, সমাজসেবী তপন বাগ, রামকৃষ্ণ চোংদার, জলধর বাগ, অসিম মিত্র, চিকিৎসক নরেন্দ্রনাথ দেয়াশী, বীণাপাণি ক্লাব এর যুগ্ম সম্পাদকদ্বয়ের অন্যতম মৃণাল কান্তি মন্ডল প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

চূড়ান্ত পর্বের খেলায় বিজয়ী রসপুর বীণাপাণি ক্লাবকে ট্রফি ও ক্যাশ ৬,০০০(ছয় হাজার) টাকা, বিজীত দল ভবানীপুর (উদয়নারায়ণপুর) রায়বাঘিনী রয়াল স্টাইকার্সকে ট্রফি ও ক্যাশ ৪,০০০( চার হাজার) টাকা দেওয়া হয়।

এছাড়াও ক্রমপর্যায়ে অনুষ্ঠিত ৪টি কোয়াটার ফাইনালে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ,২টি সেমি ফাইনালে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ, ফাইনালে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ, সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা বোলার, সেরা ফিল্ডার (ক্যাচার), ম্যান অফ দ্যা সিরিজ পুরষ্কার দেওয়া হয় সব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পারদর্শী খেলোয়াড়দের।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot